হাসান মামুন,আঞ্চলিক প্রতিনিধি (পিরোজপুর):
মানুষের অসুখ হলে নির্ভরশীল প্রিয়বান্ধব হন চিকিসৎক। রোগী নিয়ে আত্মীয়স্বজন ছুটে যায় স্বাস্থ্য সেবা নিতে। চিকিৎসকের কাছ থেকে একটু সহায়তা-সহানুভূতি পেলে রোগী যেন অর্ধেক সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু স্বাস্থ্য সেবা যথাযথ ও কাঙ্খিত ব্যবহার না হওয়ায় ওই সব ক্লিনিকের ভবিষ্যৎত নিয়ে অনিশ্চয়তা! তখন ? অসহায় হয়ে পড়ে রোগী ও তার স্বজনেরা।
গ্রামীণ পর্যায়ে সেবা দিতে স্থানীয় ভাবে সংগৃহীত জমিতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। পল্লী এলাকার মানুষের চিকিৎসা সেবা গ্রহণের নির্ভরযোগ্য এ প্রতিষ্ঠান। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েক জন নারী-পুরুষ এ প্রতিবেদককে জানান বাড়ি থেকে অনতি দুরে এসব ক্লিনিক চালু হওয়ায় তাদের অর্থ ও কষ্ট দুটোই লাঘব হচ্ছে এবং নারীও শিশুসহ স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষ ভীষণ ভাবে উপকৃত হচ্ছে।
চিকিৎসা কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্লিনিক পরিচালনার জন্য সিএইচসিপি নিয়োগের মাধ্যমে এর কার্যক্রম পুনরায় শুরুর পর থেকে প্রায় ৯ মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কোন বেতন ভাতা না পাওয়ায় মা বাবা, স্ত্রী সন্তানসহ ফ্যামিলি নিয়ে অনিশ্চয়তায় মধ্যে দিনকাটছে। এ ক্লিনিক গুলো সংস্কারের জন্য এর আগে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্ধ হলেও সিডিউল অনুযায়ী কাজ না করে নামে মাত্র সংস্কার করে বিল তুলে নেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ফলে কমিউনিটি ক্লিনিকের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ক্লিনিক গুলো সংস্কারের অভাবে বেহালদশা পরিনত হওয়ায় রোগিদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে সিএইচসিপিদের। ক্লিনিকগুলো যথাযথ ও কাঙ্খিত ব্যবহার না হওয়ায় ওই সব ক্লিনিকের ভবিষ্যৎত নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৭ উপজেলা মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক পিরোজপুর সদর ১৭ টি, নাজিরপুর ২৭ টি, নেছারাবাদ ২৯ টি, কাউখালী ১৭ টি, ভান্ডাড়িয়া ২৩ টি, ইন্দুরকানি ১২ টি ও মঠবাড়িয়া উপজেলায় ৪২ টি ক্লিনিক রয়েছে। জেলার ৭ উপজেলার ৫২ টি ইউনিয়নের ১শত ৬৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রতি মাসে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার রোগী চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ গ্রহণ করেছে।
সরেজমিনে পিরোজপুর সদর উপজেলার উত্তর কদমতলা কমিউনিটি ক্লিনিকে দেখা গেছে প্রতিদিন গড়ে ১৮ থেকে ২০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। সেখানে থাকা দায়ীত্বরত সি এইচ সি পি মোঃ মুঈদুল্লাহ মোল্লা চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীগে চিকিৎসা দিচ্ছেন। তিনি প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। সে জানান, আমি নিম্মমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা মা মাঠে ঘাটে দিন এর দিন পরিশ্রম করে আমাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। আমি জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চাকরির সার্কুলার দেখে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন, ইন্টারভিউ পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে ‘সি এইচ সিপি’ পদে ১৪ তম গ্রেডে যোগদান করি। আমার মা বাবা, স্ত্রী সন্তানসহ সকল সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে। ২০১১ সাল থেকে সি এইচ সিপি পদে চাকরিতে যোগদান করে ২০২৫ পর্যন্ত ১৪ বছরে এক টাকা বেতন বাড়েনি বরং আমাদের কে ২০২৫ পর্যন্ত ৭ বার রেভিনিউ খাতে চাকরি স্থায়ীকরণ করবে বলে মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চিঠি দিয়ে আশ^াস দেন। আমাদের অন্যান্য পেশায় যাওয়ার সুযোগ হলেও স্বাস্থ্য সেবার মত মহান পেশা ও চাকরি স্থানীকরণ চিঠি পেয়ে আমরা এই পেশায় থেকে যায়। বর্তমানে আমাদের চাকরির বয়সসীমা শেষ। আমার ইনকামের উপর ফ্যামিলি সম্পুর্ন নির্ভরশীল। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সিএইচ সিপি পদে চাররিতে থেকে প্রায় ৯ মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কোন বেতন ভাতা না পাওয়ায় মা বাবা, স্ত্রী সন্তান সহ ফ্যামিলি নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছি। এমনকি ৩ লক্ষ টাকা লোন নিয়ে এই পর্যন্ত আছি, পরে কি ভাবে লোন পরিশোধ করবো বা কি ভাবে ভবিষ্যতে চলবো জানা নাই। বাবা মা এত কষ্ট করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন এখন তাদের কাছে বোঝা, রাষ্ট্রের কাছে বোঝা যা খুবই লজ্জার। তিনি বলেন, গত আগস্টে দেশের পট পরিবর্তনের পরে শুনতে পারছি যে চাকরি ১৬ গ্রেডে নামানো হয়েছে ১৪ বছরে এক টাকা বেতন বাড়েনি, সুযোগ সুবিধা বাড়েনি বরং কমানো হয়েছে গ্রেডে ১৬ তে, আমরা ৯৮ ভাগ সি এইচ সিপি মাস্টার্স কমপ্লিট করা !!! এসময় তিনি বলেছেন যে বিভিন্ন জাতীয় দিবস, করোনা কালে ঝুঁকি নিয়ে সিসি তে ডিউটি করা, অনেক সিএইচসিপি করোনায় আক্রন্ত হয়ে মারা যান, অনেক আবার সুস্থ হন কিন্তু আমরা কোন আর্থিক সহায়তা পাই নাই। আমরা বর্তমানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে লজ্জিত হচ্ছি। এই বৈষম্যের নিরাসন চাই। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নিকট আকুল আবেদন আমাদের উপর যে বৈষম্য হয়েছে তার যথাযথ প্রতিকার যেন করেন, আমাদের এই সংকট ও লজ্জার হাত থেকে মুক্ত পাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
সিএইচসিপি আ্যসোসিয়েশন পিরোজপুরের সভাপতি মোস্তফা তালুকদার জানান, জেলার ৭টি উপজেলায় ১৬৭ জন সিএইচসিপি, সবাই উচ্চশিক্ষিত। ২০২৪ সালের জুন থেকে বেতন ভাতা বন্ধ। পরিবার পরিজন নিয়ে মানবতার জীবন যাপন করছে। সিএইচসিপি দের চাকরি স্থায়ী করন ও দ্রæত বেতন ভাতা পেতে পারে তার যথাযথ ব্যাবস্থা গ্রহনে উর্ধতন কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
জানাগেছে, ২০০০ সালে নির্মাণ ইন্দুরকানী (জিয়ানগর) উপজেলার মধ্য বালিপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক ও পাড়েরহাট ইউনিয়নের বাড়ৈইখালী কমিউনিটি ক্লিনিক জরাজীর্ন দেখা গেছে। এখানে থাকা দায়ীত্বরত সি এইচ সি পি রুনা আক্তার ও মাসুদ রানা জানান, বর্তমানে বেহাল অবস্থায় রয়েছে। রোগিদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এছাড়াও জিয়ানগর জমাদ্দার হাট ক্লিনিক, কলারণ তালুকদার হাট ক্লিনিক, চাড়াখালি ক্লিনিক ও খোলপটুয়া কমিউনিটি ক্লিনিকসহ চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ী ইউনিয়নের বিলডুমুরিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা মহিলা রোগীর সংখ্যা পুরুষের প্রায় দ্বিগুণে পৌছেছে। এসব ক্লিনিকের বাথরুম ও টিউবওয়েল দীর্ঘ দিন ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকায় আশপাশের বাড়িতে গিয়ে প্রকৃতির কাজ সারতে হচ্ছে সিএইচসিপি ও ক্লিনিকে আগত রোগীদের। তাছাড়া এসব ক্লিনিকের ফ্লোর ও দেয়ালের আস্তর খসে পরাসহ বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। দরজা জানালা গুলোতে জং(মরিচা) ধরে দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ভাঙাচুরা অবস্থায় রয়েছে ক্লিনিকের বিভিন্ন আসবাবপত্র।
তথ্যানুসন্ধ্যানে জানাগেছে, বিদ্যুৎ সংযোগ এখনো সব গুলো ক্লিনিকে পৌছায়নি। তাছাড়া এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ না দেয়ায় বিশেষ করে গ্রীস্ম মৌসুমে প্রচন্ড কষ্ট করতে হচ্ছে সিএইচসিপিদের।এমনকি কতিপয় চিকিৎসক একই স্থানে বছরের পর বছর অবস্থান এবং স্থানীয় র্দুবৃত্তরা অধিকাংশ কেন্দ্র দুনীতির আখড়ায় পরিনত করছে। দালালচক্রের আনাগোনা ও তাদেও দৌরত্মের কারণে রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া এখানে এক এক কেন্দ্রের চিকিৎসক ও কর্মচারীর অভাবও রয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। ফলে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা। সে কারনে উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে চিকিৎসা নিতে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছে রোগী ও তার স্বজনরা। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে এসব ক্লিনিকের ছাদ চুষে পানি পড়ায় ঔষধ সহ সমস্ত আসবাবপত্র ভিজে নষ্ট হচ্ছে। ছাদ চুষে পানি পড়ার কারনে ক্লিনিকের ফ্লোর সবসময় স্যাতস্যাতে অবস্থায় থাকায় রোগী ও সেবা প্রদানকারীদের অসস্তিতে পড়তে হয়। ক্লিনিক গুলোর এ বেহাল অবস্থার কারনে এখানে গর্ভবতী মায়েদের জন্য ডেলিভারীর ব্যবস্থা করা যাচ্ছেনা। সিএইচসিপিরা ক্লিনিকের এসব দূর্দশার কথা অনেকদিন ধরে সং¯িøষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে কর্তৃপক্ষ উর্ধবতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানালেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। যার কারনে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়ীত্বরত সিএইচসিপিদের। অভিযোগ রয়েছে, ক্লিনিকগুলো তেমন কোন তদারকি ও কার্যক্রম না থাকায় এবং নির্মান কাজে ব্যাপক দুর্নীতি ও দেখা দেয়ায় সেগুলোর ছাদ, দেয়াল ও মেঝের প্লাষ্টার খসে পড়তে শুরু করেছে। ফলে ক্লিনিকগুলোতে পরিবার-পরিকল্পনা বিভাগের মাঠ কর্মীরাও যাতাযাত সঠিকভাবে না করায় ক্লিনিক গুলো এক রকমের গোয়ালায় পরিনত হচ্ছে। এখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকলেও দীর্ঘ প্রত্যন্ত অঞ্চলের লক্ষাধীক মানুষের স্বাস্থ্য সেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকই একমাত্র ভরসা। এ কারনে প্রতিদিন শতশত মানুষ ক্লিনিকে সেবা নিতে আসেন। অথচ দীর্ঘদিন ধরে ক্লিনিক গুলোর এ বেহাল অবস্থার কারনে সিএইচসিপিদের চরম ভোগান্তীর শিকার হতে হচ্ছে বলে তারা এসব সমস্যার চিত্র তুলে ধরেন।
এ ব্যাপারে পিরোজপুরের সিভিল সার্জন (সিএস) ডাঃ মোঃ মতিউর রহমান বলেন, জেলার ৭ উপজেলার ১৬৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রতি মাসে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার রোগী চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ গ্রহণ করেছে। তাছাড়া ৯মাস ধরে সারাদেশের সিএইচসিপিগণ বেতন বকেয়া রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এর প্রয়োজনীয় কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার যে প্রসেস রয়েছে তার সমাধান হলেই বেত ভাতা পাবেন বলে আশ^াস দেন তিনি। তিনি বলেন, দায়িত্বরত সিএইচসিপিগণ এখন দক্ষ জনবলে রূপ নিয়েছে। তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ করা হলে দেশের স্বাস্থ্য সেবায় আমূল পরিবর্তন আসবে। এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে সেসব ক্লিনিক গুলোর দ্রæত সংস্কারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার প্রতিবেদন পাঠানোও হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবার একি হাল-কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রমে বিপর্যস্থ স্বাস্থ্য সেবা
Date: