গণমাধ্যম হত্যা ও বাকস্বাধীনতা হরণের এক কলঙ্কিত দিন
আগামীকাল, ১৬ জুন, বাংলাদেশে “সংবাদপত্রে কালো দিবস” হিসেবে পালিত হবে। ১৯৭৫ সালের এই দিনেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত এক সিদ্ধান্তে দেশের সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়, কেবলমাত্র সরকার অনুগত চারটি পত্রিকা ছাড়া। এর ফলে হাজার হাজার সাংবাদিক মুহূর্তেই বেকার হয়ে পড়েন, সংবাদপত্র শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে, বিনিয়োগকারীরা দেউলিয়া হয়ে যান এবং জনগণ বঞ্চিত হয় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তথ্য জানার অধিকার থেকে।
এই পদক্ষেপ ছিল পূর্ববর্তী ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর সরাসরি ধারাবাহিকতা, যার মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা “বাকশাল” প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী এ সংশোধনী ছিল জাতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যা গণমাধ্যম স্বাধীনতাকে চরমভাবে সংকুচিত করে তোলে।
১৯৭৬ সাল থেকে দেশের সাংবাদিক সমাজ প্রতিবছর এই দিনটিকে ‘সংবাদপত্রে কালো দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এক সময় সব মতাদর্শের সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীরা দিবসটি পালনে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ কমে গেছে। তবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা (জেএসএস) বরাবরের মতোই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছে। এ বছরও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হবে।
১৯৭৫ সালের ১৬ জুনের সেই ঘটনার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর এক নির্মম আঘাত হানা হয়েছিল। সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়ে বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে। তখনকার “সরকারি প্রচারপত্র” রূপে চারটি পত্রিকা চালু রেখে বাকি সব কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়। এ ঘটনার নেপথ্যে ছিল স্বেচ্ছাচারী শাসন প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা।
পরবর্তীতে, ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। তার নেতৃত্বেই গণমাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা হয়, যেখানে শতফুল ফুটেছিল।
তবে এই স্বাধীনতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে আবারও সংবাদমাধ্যমকে দমন-পীড়নের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। বিগত প্রায় দেড় দশকে বহু জনপ্রিয় সংবাদপত্র, বেসরকারি টিভি চ্যানেল এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দৈনিক আমার দেশ-এর অফিসে আগুন দেওয়া হয়, বন্ধ করা হয় চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, সিএসবি সহ দুই শতাধিক গণমাধ্যম। হামলার শিকার হয় দৈনিক নয়া দিগন্ত ও দৈনিক সংগ্রাম। বহু সাংবাদিককে দেশান্তরি হতে হয়েছে, আবার কেউ কেউ জীবন হারিয়েছেন বা বন্দিত্বের শিকার হয়েছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার সিকিউরিটি আইন প্রয়োগ করে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়। বিভিন্ন পর্যবেক্ষক সংস্থার মতে, শেখ হাসিনার শাসনামলে ৫৮ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন, বহু সাংবাদিককে কারারুদ্ধ ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ভিন্নমতের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে ১৬ জুন আজ শুধুই একটি স্মৃতিচিহ্ন নয়—এটি গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার একটি চেতনার দিন। এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, বাক-স্বাধীনতা রক্ষায় সাংবাদিক সমাজকে কতটা বড় মূল্য দিতে হয়েছে, এবং ভবিষ্যতেও কতটা সজাগ ও সোচ্চার থাকতে হবে।
মুহম্মদ মনজুর হোসেন
চেয়ারম্যানঃ বাংলাদেশ নিউজ সিন্ডিকেট
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ দৈনিক সমতল।