দক্ষিণ আফ্রিকায় দুই বছরে শরীয়তপুরের ১০ জন খুন

দক্ষিণ আফ্রিকার এক বিপণিবিতানে শরীয়তপুরের দুই যুবককে গত রোববার গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। এ নিয়ে গত দুই বছরে শরীয়তপুরের ১০ যুবককে দক্ষিণ আফ্রিকার সন্ত্রাসীরা চাঁদার দাবিতে হত্যা করল। এ অবস্থায় জীবিকার তাগিদে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত ব্যক্তিদের পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। অনেক যুবক তাঁদের ব্যবসা ফেলে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন এবং অনেকে অন্য দেশে চলে যাচ্ছেন। তবে জেলার কতজন ব্যক্তি দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন, এর তথ্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নেই।

গত রোববার রাতে নিহত ব্যক্তিরা হলেন ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিসার ইউনিয়নের কাইচকুড়ি গ্রামের উজ্জ্বল মাঝি (৩২) ও তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক নড়িয়া উপজেলার বিঝারী ইউনিয়নের কাপাশপাড়া গ্রামের আলম মোল্যা (৩৪)। কেপটাউন রাজ্যের মালমাজবেরি এলাকার একটি বিপণিবিতানে হামলা চালিয়ে তাঁদের হত্যা করা হয়।

নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উজ্জ্বল মাঝি ২০০৮ সালে সাউথ আফ্রিকা যান। সেখানে তিনি একটি বিপণিবিতান খোলেন। গত ১০ বছরে তিনি চারটি বিপণিবিতান খোলেন। স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে তাঁর কাছে চাঁদা চাইত। মাঝেমধ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে যেত সন্ত্রাসীরা। রোববার স্থানীয় সময় রাত পৌনে আটটার দিকে মালমাজবেরি এলাকার বিপণিবিতানে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা উজ্জ্বলের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। পরে আলম মোল্যাকেও হত্যা করে। এ সময় সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে ওই প্রতিষ্ঠানে আসা স্থানীয় এক নাগরিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। 

গত মঙ্গলবার দুপুরে উজ্জ্বল মাঝির গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, মা মরিয়ম বেগম ও ভাই মোক্তার হোসেন আহাজারি করছেন। উজ্জ্বলরা চার ভাই। তিনি সবার ছোট। ভাইয়েরা ২০০৮ সালে বাবার জমি বিক্রি করে তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠান। আগামী জানুয়ারি মাসে তাঁর দেশে ফিরে বিয়ে করার কথা ছিল। মা মরিয়ম বেগম পাশের গ্রামে মেয়ে দেখে আংটিও পরিয়ে রেখেছেন। 

উজ্জ্বলের ভাই আক্তার হোসেন বলেন, সন্ত্রাসীরা প্রায়ই উজ্জ্বলের কাছে চাঁদা চাইত। উজ্জ্বল মাঝেমধ্যে চাঁদা দিত। হঠাৎ কেন সন্ত্রাসীরা ভাইকে হত্যা করল, বুঝতে পারছেন না। যখন দোকানে হামলা হয়, তখন উজ্জ্বল বাঁচার জন্য বাথরুমে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সন্ত্রাসীরা বাথরুমেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। 

আর কাপাশপাড়া গ্রামের আলম উন্নত জীবন গড়ার জন্য ২০১৭ সালে সাউথ আফ্রিকা যান। দেশে তাঁর বাবা, মা, স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান আছে। 

দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসী হামলায় জেলার আরও অনেকে মারা গেছেন। শরীয়তপুর সদর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের জহিরুল ইসলাম হাওলাদার (৪২) থাকতেন কেপটাউনের ক্রাইফনটেন্ট এলাকায়। গত ২ মার্চ সন্ত্রাসীরা চাঁদা না পেয়ে তাঁকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে সড়কে ফেলে কুপিয়ে হত্যা করে। জহিরুল ইসলামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ছিলেন একই গ্রামের পারভেজ হোসেন (২৬)। প্রতিষ্ঠানের মালিককে হত্যার পর তিনি আতঙ্কে ক্রাইফনটেন্ট এলাকা ছেড়ে কাজ নেন কেপটাউনের মাকশা এলাকার একটি বিপণিবিতানে। গত ১৯ এপ্রিল সন্ত্রাসীরা ওই বিপণিবিতানে ডাকাতি করার সময় পারভেজ হোসেনকেও হত্যা করে।

জহিরুল ইসলামের স্ত্রী নাসিমা ইসলাম শরীয়তপুরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। স্বামীর মৃত্যুতে তিনি ভেঙে পড়েছেন। একমাত্র শিশু কন্যাকে নিয়ে বেঁচে আছেন। নাসিমা ইসলাম বলেন, সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে জহিরুল বিদেশে গিয়েছিলেন। জানেন না আল্লাহ কেন এমন করলেন?

সদর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের আহম্মেদ সুমন ও তাঁর ভাই বাচ্চু ঢালী বেশ কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকেন। আহম্মেদ সুমন গত জানুয়ারিতে ছুটিতে দেশে আসেন। তিনি দেশে আসার পর স্বজনেরা তাঁকে আর যেতে দেননি। কিন্তু তাঁর ভাই বাচ্চু ঢালী এখনো সাউথ আফ্রিকায় রয়ে গেছেন। তাঁর জন্য পরিবারের সদস্যরা সব সময় উদ্বিগ্ন থাকেন। 

আহম্মেদ সুমন বলেন, শরীয়তপুরের যাঁরা সাউথ আফ্রিকায় থাকেন, তাঁদের অধিকাংশই ব্যবসা করেন। তিন-চার বছর ধরে সেখানকার সন্ত্রাসীদের উৎপাত বেড়ে গেছে। তারা নিয়মিত চাঁদা চায়। চাঁদা না দিলেই হামলা চালিয়ে হত্যা করে। আতঙ্কে থাকেন সব সময়। 

শরীয়তপুর পৌর এলাকার প্রদীপ দত্ত থাকতেন সাউথ আফ্রিকার কেপটাউনে। সেখানে প্রায়ই সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশি প্রবাসীদের ওপর হামলা করত। আতঙ্কে তিনি ইউরোপ যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। গত জুলাইয়ে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। ২৪ আগস্ট তিনি নতুন জীবিকার জন্য পর্তুগালে যান। মুঠোফোনে প্রদীপ দত্ত বলেন, ‘এক যুগের বেশি সময় সাউথ আফ্রিকা ছিলাম। সেখানে আর টিকতে পারলাম না। সন্ত্রাসীদের ভয়ে পালাতে হলো। জীবনের নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘদিনের ব্যবসা-বাণিজ্য ফেলে চলে আসতে হলো।’ 

জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। এভাবে প্রবাসীদের হত্যা করা হলে তো মানুষ আতঙ্কে আর সেখানে যাবে না। বিষয়টি তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানাবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাতে এ সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নেয়, সে অনুরোধ করে চিঠি দেওয়া হবে