জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার মূল গল্প- মুহম্মদ আলতাফ হোসেন

নিউজ ডেস্কঃ

সত্তরের দশকের শেষভাগে ঢাকায় বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় সম্মেলন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত রাজপথে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন মীর লিয়াকত আলী। তখনো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল বৃহত্তর ঐক্যের বৈষম্যহীন চিন্তাচেতনায় জাড়িত একটি অবাধ সাংবাদিক সংগঠন কিভাবে গড়ে তোলা যায়। জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা লগ্নের কথা প্রসঙ্গে মীর লিয়াকত বলেন, ‘আমার মন-ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুহম্মদ আলতাফ হোসেন তখন ডিইউজের ডাকসাইটে নেতা। দৈনিক আজাদের সিনিয়র সাব-এডিটর আলতাফ হোসেনের সাথে ঐদিন অনেকটা কাকতালীয় ভাবেই মিছিলে থেকে দেখা। তবে সে জানতো সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্যে ঢাকা আসছি আমি । এমনিতে হয়তো পরের দিন দেখা করতাম ওর সাথে। মছিলটি তোপখানা অতিক্রম করছিল, আলতাফ প্রেসক্লাবের দিকে আসছিল। তাকে দেখেই আমি বেরিয়ে এলাম মিছিল থেকে। তাকেও আর প্রেসক্লাবের দিকে যেতে না দিয়ে দু’বন্ধু উঠলাম রিক্সায়। অলতাফ বলেছিল ‘কি ব্যপার? তুমি যে মিছিল ছেড়ে চলে এলে ! সিরিয়াস কিছু?’ আমি বলেছিলাম ‘আমি মিছিল শেষ করে এলে আর তুমি প্রেসক্লাবে গেলে আজ আর দেখা হবেই না, কথাও হবে না। জরুরী কথা! কারণ বিকেলে আমাদের কাউন্সিল।’ রিক্সাকে দৈনিক বাংলার দিকে যেতে বলে রিক্সায় বসেই আলতাফকে মনের জমে থাকা কথাগুলো বলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমি জানতাম আমার জানা মতে এই একটি লোকই আছে যে একবার হ্যাঁ বললে দেশব্যাপী স্বপ্নের সংগঠন গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। তবে না ভেবে হুট করে কোন সিদ্ধান্তে যাওয়া সর্বদাই আলতাফের স্বভাববিরুদ্ধ। অন্তত: যতটুকু তাকে আমি জানি। ধৈর্য্য নিয়ে সব শুনে স্বভাব বিরুদ্ধ হলেও তাৎক্ষণিকভাবে হ্যাঁ বলায় আমি অবাকই হয়েছিলাম। আসলে অত্যন্ত সেনসিটিভ ও ব্যক্তিত্বশীল আমার এ বন্ধুটিকে আমি ভালোভাবেই জানতাম।

তাই তার সম্মতিতে আমি দারুনভাবে আশ্বস্থ হলাম । সেই রিক্সায় চড়েই জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা গড়ে তোলার প্রাথমিক রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হলো । দুজনের কাজ শুরু হলো। কাজ করতে গিয়ে কাজের বিশালত্বের অবস্থান অবলোকন করে আমি তো সব গুলিয়ে ফেলার মতো অবস্থায়। কারণ সারা দেশ নিয়ে কাজের ধরন আমার অবস্থানে চাট্টিখানি কথা ছিল না । যদিও সারা জীবন অনেক সংগঠন করেছি! কিন্তু জাতীয়ভাবে সারা দেশ নিয়ে এ কাজটি ছিল আমার জন্য অত্যন্ত জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং। চ্যালেঞ্জও বিশাল। কিন্তু আলতাফের কাজের ধরন দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। ঠান্ডা মাথায় জটিল বিষয়গুলিকে সে এমনভাবে সহজ করে আনতে পারে সত্যিই তা ভাবা যায় না। তার কাজ দেখে বুঝলাম সাংবাদিক সংস্থার গঠন একটি অতি সহজ কাজ! আমরা নিয়মিত বসতে লাগলাম। দুজনের সম্মিলিত চিন্তাভাবনা এগিয়ে চললো। আর্থিক বিষয়গুলো আমিই অনেক কষ্টে যোগান দিল্মা। সাপ্তাহিক নবজাগরণ পত্রিকায় আমরা অস্থায়ী অফিস করলাম। নবজাগরণ সম্পাদক এডভোকেট আবুল কাসেমের নাম এভাবেই জড়িয়ে গেল সংস্থার প্রতিষ্ঠার সাথে। ১৯৮১ সালের ১৫ জুলাই আমরা সাংবাদিক সমাবেশের প্রাথমিক সময় নির্ধারন করলাম। এসময় আমাদের দু’জনের সাথে যুক্ত হলেন মোস্তফা ইয়াসিন, আবুল হোসেন, শাহজাহান মোল্যা, সুমন মাহবুব, প্রমুখ’র মতো মেধাসম্পন্ন পরিশ্রমী নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব। তাদের নি:স্বার্থ সময়দান ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এ সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমাদের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হলো। আমরাও কিছু কিছু সমস্যা এভয়েড করতে পারলাম না। আজকের যুগের মতো সে সময় মোবাইল ফোনের সুযোগ ছিল না। সংগঠনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে ল্যান্ড ফোনও পাওয়া সহজ সাধ্য ছিল না । ঢাকায় পাওয়া গেলেও মফস্বলে যোগাযোগ ছিল কষ্টকর । চিঠির বিকল্প কিছু ভাবা যেত না। তাই গৃহিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৫ জুলাই অনিবার্য কারণে ‘পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে চিঠি প্রেরণ করা হলো । এভাবেই কেটে যায় আরো কয়েক মাস । এসময় কিছুটা প্রতিকুলতায়ও আমাদের পড়তে হয়েছে। তবে তা ছিল সাময়িক। কিন্তু আমরা অমাদের দৃঢ় প্রত্যয়ে অটল ছিলাম। সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আমাদের আর বেগ পেতে হয়নি।

১৯৮১ সালের ২৩ ডিসেম্বরের সভায় আমরা সমাবেশ আহ্বানের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলাম। চিঠির মাধ্যমে সভা ডাকা হলো।

১৯৮২ সালের ১২ ফেব্র“য়ারী সমাবেশের চুড়ান্ত তারিখ নির্ধারিত হলো। সে সময় সাংবাদিক সমিতির দু’একজন নেতা বিদ্রুপের সুরে কথা বললেও আমরা কারো সাথে কোন বিতর্কে যাইনি। তখন শুনেছিলাম সাংবাদিক সমিতি নাকি সাপ্তাহিক পত্রিকার সংবাদদাতাদের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ সহসা নেবার জন্য বৈঠক ডাকছে। অমরা আর কোন কিছুতে কান দিলাম না। ১৯৮২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী কমলাপুরে সাংবাদিকদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো। উপস্থিতি দেখে খোদ আলতাফের চোখও চড়ক গাছ! আশাতিরিক্ত উপস্থিতি আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনাকে এগিয়ে দেয় বহুদূর। ১২ ফেব্রুয়ারীর জনাকীর্ণ সভায় আলতাফের প্রস্তাবে আমাকে আহ্বায়ক নির্বাচিত করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সমাবেশ এবং আহ্বায়ক কমিটি গঠনের এ খবরটি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পরিবেশন করায় দ্রুত সংগঠন প্রতিষ্ঠার খবর সারা দেশে পৌঁছে যায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। আমরা সাংগঠনিক কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে গেলাম। প্রথম পূর্নাঙ্গ জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠিত হলো । আমার ওপরই অর্পিত হলো সভাপতির গুরু দায়িত্ব। আবুল হোসেনকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হলো। আলতাফ কোন দায়িত্ব নিতে চাইলেন না । কারণ তিনি তখন ডি.ইউ.জে’র বড় নেতা। তবে সহ-সভাপতি হিসেবে মূল কমিটিতে তিনি থাকলেন। এভাবেই পর পর তিন বার আমি সভাপতি নির্বাচিত হই। এরপরও সংগঠনের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আমাকে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও অন্যতম নীতিনির্ধারক হিসেবে বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পণ করা হলে আমি তা আন্তরিকভাবে পালনের চেষ্টা করি। ১৯৯৩ সাল থেকে মুহম্মদ আলতাফ হোসেন এখনো সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৮২ সালে হাটি হাটি পা পা করে যে সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ তার বয়স প্রায় বত্রিশ বছর। সাংবাদিকদের কল্যাণে বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সংস্থা এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নও করছে। সংস্থা এখন সরকারী নিবন্ধনকৃত। এটি আলতাফের বহু পরিশ্রমের ফসল। শুধু তাই নয় আলতাফের একক প্রচেষ্টায় সংগঠনকে আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত করা সম্ভব হয়েছে। আজ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ১২০০০ ছাড়িয়ে গেছে। সারা দেশের বিভাগ জেলা উপজেলায় বি¯তৃত হয়েছে তিন শতাধিক শাখা। আশা করছি সংগঠন আগামী দিনগুলোতে তার নিজস্ব চেতনায় এগিয়ে যাবে।

দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস অনুযায়ী জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয়ভিত্তিক প্রথম সাংবাদিক সংগঠনই শুধু নয়, দেশের বৃহত্তম অবাধ ও বৈষম্যহীন জাতীয়ভিত্তিক একমাত্র সাংবাদিক সংগঠন যা সাংবাকিদের কল্যাণেই নিবেদিত। আপনিও আমাদের সহযোগী হোন।