গালিবের রসিকতা

‘মিরের কবিতা বুঝলাম, সওদার ভাষাও বুঝি

কিন্তু আপনার কবিতা আপনি, নয়তো খোদা ছাড়া কেউ বোঝে না।’ 

এরপর মির্জা গালিব নিজে উত্তর দিলেন: 

 ‘প্রশংসার বাসনা নেই, নেই স্বীকৃতির অভিলাষ

আমার কবিতায় যদি অর্থ না থাকে, না–ই থাকল।’ 

সেই সময় গালিব এক মান্য অভিধানের ভুল ধরে লিখলেন নিজে একটি অভিধান। ভাষার জগতে তা–ই নিয়ে কোলাহল পড়ে গেল। যা লিখলেন, তা বাদ দিয়ে গালিবের বদনামি নিয়ে আলোচনা শুরু হলো বেশি। দিনে একাধিক বেনামি চিঠি আসা শুরু হলো। তাতে খিস্তি-খেউর ভর্তি। একদিন দুপুরের খাবার খাচ্ছেন গালিব। ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে গেল। প্রেরকের নাম নেই, অচেনা হাতের লেখা দেখে তিনি সেটা এক সাগরেদকে দিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার দেখো তো।’ তবে চিঠি পড়ে শিষ্যটি চুপ। গালিব বুঝলেন, এটি সেই গালমন্দের চিঠি। তাই নিজেই নিয়ে পড়ে দেখলেন। হেসে বললেন: 

‘গাধাটা গালও দিতে জানে না। বুড়ো লোককে মা ধরে গাল দিতে নেই। এদের গাল দিতে হয় মেয়েকে নিয়ে। জোয়ান লোককে গাল দিতে হয় বউকে নিয়ে। এদের বউয়ের জন্য মনে ভালোবাসা থাকে। আর বাচ্চাকে গাল দিতে হয় তার মায়ের নাম ধরে। কারণ, এর চেয়ে আপন তার আর কেউ নেই। এ যে আমার মতো বাহাত্তর বছরের বুড়োকে মা ধরে গাল দিচ্ছে! এমন বেকুব আগে দেখিনি।’ 

এ তো গেল কবিদের সঙ্গে কবির দড়ি টানাটানি। এমন রসিক কিন্তু জটিল কবিকে সাধারণ মানুষ খুব পছন্দ করে। তিনি তাদের কাছে পরিচিত ‘চাচা গালিব’ নামে। গালিবের নামে চালু আছে এত কবিতা, যার খুব কমই গালিবের নিজের লেখা। যাঁর কবিতা নিয়ে ভারী কাচের চশমাওয়ালা গবেষকেরা নিত্যই ভিরমি খান, তিনি কী করে সাধারণে এত প্রিয় হন! 

এটা বুঝতে হলে মির্জা গালিবের সময়টাকে বুঝতে হবে। আর এ-ও বুঝতে হবে যে তিনি তাঁর সময়কে বুঝতে পেরেছিলেন। তখন কয়েক শতাব্দীর পরাক্রান্ত মোগল সাম্রাজ্য লালকেল্লার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। নিজে অভিজাত পরিবারের লোক হয়ে ইংরেজদের কাছে পৈতৃক মাসোহারার জন্য মামলা লড়ছেন গালিব। যা কিছু এত দিন মহান ছিল, তার সব বেমালুম মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। এই সব দেখে জগতের ধ্রুপদি ব্যাখ্যায় সন্দিহান হয়ে পড়েন তিনি। ফলে একদিন গরমকালে খোলা ছাদে শুয়ে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে এই কবি বলেছিলেন, ‘আকাশের তারাগুলো এমন এলোমেলো ছড়ানো, এই জগৎ-সংসার কেউ পরিকল্পনা করে তৈরি করেছে কি না, সন্দেহ হয়!’ 

তবে এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না যে গলিবের মাসিক রোজগার ছিল ২৭ টাকা। আর ঘরে ছিল ২০ জন খাওয়ার লোক। এদিকে রাতে বিদেশি মদিরা, খাঁটি গোলাপজল, প্রতিদিন তাজা ফুল, সোহান হালুয়া আর কাবাব ছাড়া তাঁর চলে না। এর মধ্যে আবার পাওনাদার ঘরে এসে তাগাদা দিয়ে যা-তা কথা শুনিয়ে যায়। এই সব নিয়ে বন্ধুকে চিঠিতে লেখেন গালিব: 

 ‘এই সব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার এক উপায় আমি বের করেছি। নিজেকে আমি আরেকজন ভেবে নিই। যখন পাওনাদার ঘরে এসে অপমান করে যায়, তখন নিজেকে আরেকজন ভেবে নিয়ে নিজের দুর্দশায় নিজেই মজা পাই। তখন নিজেকে বলি, নে, আরও ধার কর, ফুলওয়ালার কাছ থেকে ফুল, বাজাজের থেকে কাপড়, সাহুকারের কাছ থেকে টাকা ধার কর! আরে, ধার করার আগে তো ভাববি যে শোধ করবি কোত্থেকে!’ 

রাজকৃপা আশ্রিত কবিদের দিন শেষ। রাজা নিজেই মাসোহারা নিয়ে চলেন! বহু প্রতীক্ষার পর সেই ভাঙা দরবারের সভাকবি হলেন গালিব। এর কয়েক দিন পর মোগল শাসনই আর থাকল না। লক্ষ্ণৌর যে নবাবের কাছ থেকে মাসিক ভাতা পেতেন, গদি হারালেন সেই নবাবও। সেই সময় কবিকে একজন বললেন, ‘আপনি রামপুরের নবাবের কাছে সাহায্য চান।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে গালিবের বক্তব্য ছিল, ‘আমার সঙ্গে বদনসিবি জড়িয়ে আছে। যে আমাকে সাহায্য করে, তারই কপাল পোড়ে। রামপুরের নবাবের সঙ্গে দুশমনি থাকলে নিশ্চই আমি তাঁর সহায়তা চাইতাম।’ 

এরপর অবশ্য রামপুরের ওই নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল গালিবের। বিদায় নেওয়ার সময় নবাব তাঁকে বললেন, ‘মির্জা, খোদা হাফিজ। মানে আপনাকে খোদার হাতে সঁপে দিলাম।’ গালিব বললেন, ‘হায় হায়, এ কি বললেন নবাব সাহেব!’ বিস্মিত হয়ে নবাব বললেন, ‘ভুল কী বললাম!’ এবার কবি জবাব দিলেন, ‘খোদা আমাকে নিয়ে নাচার হয়ে আপনার কাছে পাঠালেন আর আপনি আবার আমাকে ফিরিয়ে তাঁর কাছে সঁপে দিচ্ছেন!’ 

গালিব বুঝতে পেরেছিলেন, অতীত হয়ে গেছে বিগত মহিমার কাল। নবাব-বাদশাহরা নিজেও তাঁর মতোই ব্যতিব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন—আজ গদিতে তো কাল পথে। পুরোনো দিনের সঙ্গে পুরোনো সংস্কৃতিও মিলিয়ে যাচ্ছে। এটা যতই বেদনারই হোক, তা আর ফিরে আসবে না। ১৮২৯ সালে কলকাতায় গিয়ে ইংরেজদের তৈরি শহরের সঙ্গে মোগল দিল্লি তুলনা করে তাঁর এই ভাবনা আরও পোক্ত হলো। এ সময় কবির এক বন্ধু বললেন, ‘ভাবছি ছেলেকে শাস্ত্র পড়িয়ে আলেম বানাব কি না!’ গালিব বললেন, ‘ভাই, যে মরে গেছে তাকে পেলে-পুষে কোনো লাভ নেই, ছেলেকে ইংরেজি পড়াও।’ নিজের একটা শেরে তিনি বলছেন: 

‘বিশ্বাস আমাকে থামায়, যখন 

অবিশ্বাস টানে সামনে,

কাবা আমার পেছনে, সামনে 

গির্জা।’ 

এখানে ‘বিশ্বাস’ হলো বিগত সামন্তকাল। আর অনাগত ‘অবিশ্বাস’ হলো ইংরেজদের জামানা—নতুন পুঁজির শাসন। ভারতবর্ষ তখন নিজের নাড়ি ছিঁড়ে নতুনকে বেদনাময় স্বাগত জানাচ্ছে প্রবল অনিচ্ছায়। নতুন সময়ে তৈরি হচ্ছে নতুন পরিচয়। এত দিন ক্ষমতা আর আভিজাত্যের যেসব উৎস বিদ্যমান ছিল, তা আর বহাল নেই। সেই কফিনে শেষ পেরেক ঠুকল ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, বিদ্রোহের পরাজয়। তারপর দিল্লিতে নেমে এল প্রলয়। তত দিনে নিজেদের বিজয়ের স্বরূপ বোঝাতে পুরোনো সব বিখ্যাত মহল ভেঙে রাস্তা, ময়দান বানানো শুরু করেছে ইংরেজরা। এ পরিপ্রক্ষিতেই গালিব বলতেন, যে দিল্লির পরিচয় হলো লালকেল্লা, জামে মসজিদ, চাঁদনিচক। এর কোনোটাই আর আগের রূপে থাকল না। ঘরের আসবাব, দামি কাপড় বিক্রি করে তিনি তখন দিনের আহার জোটাতেই ভীষণভাবে নাকাল হচ্ছেন। তাঁর একমাত্র ভাই ছিলেন মানসিক রোগী, তিনি সেই সময়েই মারা গেলেন। তখন এমন এক অবস্থা ছিল যে মৃতকে কবরস্থানে নিয়ে সমাধিস্থ করারও অনুমতি ছিল না। অগত্যা পুরোনো চাদর জড়িয়ে বাড়ির আঙিনাতেই ভাইকে কবর দেওয়া হলো। ওদিকে বিদ্রোহ দমিয়ে ইংরেজরা সে সময় নতুন করে সব বাসিন্দার তদন্ত সাপেক্ষে শহরবাসের অনুমতি দিচ্ছে। গালিবেরও ডাক পড়ল কর্নেল ব্রাউনের কাছে। সাক্ষাৎকার দিতে হবে। কর্নেল তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মির্জা, তুমি মুসলমান?’ গালিবের জবাব, ‘জি, আধা।’ ‘আধা মুসলমান? সে আবার কী?’, অবাক হয়ে শুধালেন কর্নেল। গালিব উত্তর দিলেন, ‘মদ খাই, শুয়োর খাই না।’ 

দিল্লিতে আর আগের মতো দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন ছুটে আসে না। কলকাতা সে সময় নতুন রাজধানী। সেখানে কল খুললে জল, রাস্তায় গ্যাসের বাতি, প্রশস্ত সড়ক, নতুন রকমের প্রশাসন—আরও কত কী। ভারতবর্ষের কেন্দ্র অনেক কাল পর সরে গেছে দিল্লি থেকে। এ সময় গালিবের এক বন্ধু বেড়াতে এসেছেন দিল্লিতে। বন্ধুকে নিয়ে শহর ঘুরিয়ে দেখেচ্ছেন কবি। দিল্লিতে তখনো নিত্যকার মোট বইতে ব্যবহৃত হতো গাধা। ফলে শহরে গাধা ছিল অনেক। সেটা লক্ষ্য করে বন্ধু বললেন, ‘মির্জা, দিল্লিতে দেখছি অনেক গাধা!’ মির্জা হেসে অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না রে ভাই, দিল্লিতে গাধা নেই, সব বাইরে থেকে আসে।’ 

আগ্রায় জন্মেছেন গালিব, দিল্লিতে এসেছিলেন বিবাহসূত্রে। তাঁর স্ত্রী উমরাও বেগম ছিলেন খুব বিধি–নিষেধ মানা মানুষ। তাই গালিব যেহেতু মদ্যপান করতেন, সেহেতু তাঁর জন্য আলাদা রান্নার হাঁড়ি ও ভিন্ন বাসনপত্র রেখেছিলেন স্ত্রী। এই পাত্রের খাবারও উমরাও খেতেন না। এর মধ্যে নিজের প্রিয় শিষ্য গোপাল তফতার বন্ধু উমরাও সিং জওহরের দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গেলে শিষ্যকে এক চিঠিতে যথেষ্ট আক্ষেপের সুরেই গালিব লিখলেন: 

 ‘উমরাও সিং জওহরের হাল দেখে ওর জন্য ঈর্ষা আর নিজের জন্য দয়া হয়। আল্লাহ আল্লাহ! তার পায়ের শিকল কাটল দুই–দুইবার! আর এক আমি ৫০ বছরের বেশি হয়ে গেল, ফাঁসির দড়িতে ঝুলছি। দমও বের হয় না, দড়িও ছেঁড়ে না।’ 

কিন্তু ওই আক্ষেপই সার। স্ত্রী প্রসঙ্গে এই গালিবই আবার বন্ধুমহলে পরিচিত ছিলেন ‘অদ্ভুত’ বলে । সাতটি সন্তান জন্মে তিন মাস বয়সের মধ্যে মারা গেছে সবাই। এ কারণে সেই কালের বাস্তবতায় কবিকে আবার বিয়ে করার পরামর্শ দিতেন তাঁর পরিচিতজন ও বন্ধুবান্ধবেরা। তবে গালিব কখনো সেই পরামর্শ গ্রহণ করেননি। তাঁর নিকটজনেরা কেউই এর অর্থ বুঝতে পারেননি। অবশ্য স্বর্গে যেতেও কবি শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন, সেখানে হুরদের চেহারা তাঁর প্রেয়সীর মতো হতে হবে। 

এই মাটি–পৃথিবী আর পঞ্চেন্দ্রিয়ের দেওয়া অনুভূতিকে অনন্য মানতেন মির্জা গালিব। এ কারণেই দিওয়ানে গালিব বইতে হয়তো লিখেছিলেন: 

‘বেদনার এই সংগীতকেও অনন্য 

 উপহার বলে জেনো হে হৃদয়

এই অস্তিত্বের বীণা একদিন সুর 

ভুলে নীরব হয়ে যাবে।’ 

তাঁর কাছে জীবনের প্রতিটি ক্ষণ ছিল ভীষণ মূল্যবান। ভিক্টোরীয় যুগের ইংরেজ রাজকবি লর্ড টেনিসনের অমর কবিতা ‘লোটাস ইটার’–এর অডিসিউস যেমন চেনা এই বিস্মরণের কূল ছেড়ে অচেনা অকূলে ভাসতে চেয়েছে, আমাদের মির্জা গালিবও তেমনি স্রষ্টার কাছে করেছেন অনুরোধ: 

‘স্বর্গকে নরকের সঙ্গে মিলিয়ে 

 ফেললে কেমন হয়? 

ঘুরে বেড়ানোর জন্য আরেকটু 

 বেশি জায়গা পাওয়া যেত!’ 

এই কথা ভেবেই উর্দু কবি আল্লামা ইকবাল তাঁর জাভেদনামায় দেখিয়েছেন যে ইরানি কবি তাহিরা, মনসুর হাল্লাজ আর গালিব স্বর্গে যেতে অস্বীকার করে অন্তহীন চলাকে বেছে নিয়েছেন। 

বর্তমানকে অবিকল্প ও প্রশ্নাতীত চিরকালীন বলে মেনে নিলেই তার নিজের রূপে টিকে থাকে বর্তমান। এভাবেই প্রতিদিন আজকের আদলে আগামীকালকে জন্ম দিই আমরা। গালিব এ ধরনের মানসিক জড়তাকে মানতেন না। তাঁর রসিকতা করার অভ্যাস সেই প্রশ্নহীনকে প্রশ্ন করত। আমাদের সবার মধ্যেই বোধ হয় লুকিয়ে আছে সেই অভ্যাস। না হলে দুরূহপ্রিয় গালিব সাধারণে এত প্রিয় হবেন কেন!