একটু হাসুন

‘এই রে, হাসলেই বুঝি আমি খেলো হয়ে গেলাম। গেল গেল, আমার ব্যক্তিত্ব গেল’—এই ভেবে নিজের মধ্যে একটা নকল ভাব ধরে রাখতে অনেকেই রামগরুড়ের ছানা হয়ে থাকে। হাসির ঘটনায়ও হাসে না। যেন সব সময় কপাল কুঁচকে থাকা বিরক্ত এক ‘বড় কর্তা’। কিন্তু এই না হেসে থাকার চেষ্টা মোটেও ঠিক নয়। শরীরে আর মনের দিক থেকে ভালো থাকার জন্য হাসতেই হবে। যৌক্তিক কারণে অবশ্যই হাসতে হবে। হাসির এই ‘হা হা’, ‘হো হো’, ‘হি হি’ উচ্চারণগুলো হচ্ছে বিশ্বজনীন ভাষা! প্রায় সব ভাষাতেই হাসির বহিঃপ্রকাশ একধরনের। পৃথিবীতে মানুষ একমাত্র প্রাণী যে পরিপূর্ণভাবে হাসতে পারে। তবে শিম্পাঞ্জি, ইঁদুর, ডলফিন, কুকুরসহ বেশ কিছু প্রাণী তাদের বিভিন্ন আচরণে বা শব্দে আনন্দের ভাব প্রকাশ করতে পারে বলে গবেষকেরা প্রমাণ পেয়েছেন, কিন্তু সেটা হাসি নয়। আর হায়েনার হাসি বলে যেটা রয়েছে, সেটা আসলে হায়েনার ডাক।

হাসি কী? 

হাসি হচ্ছে মানুষের আবেগের বহিঃপ্রকাশ। ভালো লাগা, খুশি, আনন্দ আর কোনো অর্জনের পর আমাদের মনে যে আবেগের সঞ্চার হয়, সেটা ফুটে ওঠে হাসির মধ্য দিয়ে। আমরা কিন্তু খুব সচেতনভাবে ‘এখন হাসতে হবে, সবাই হাসুন’ এমনভাবে হাসি না। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের উৎসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাসির প্রকাশ ঘটে। আর সচেতনভাবে ‘হাসতে হবে’, তাই মনে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে রাখাটা হচ্ছে কৃত্রিম হাসি। 

আবেগের কারণে মস্তিষ্কের ভেন্ট্রোমিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স উদ্দীপ্ত হয়, এর ফলে ‘এন্ডোরফিন’ নামক রাসায়নিক বস্তুর নিঃসরণ ঘটে, তাই আমরা হাসি। আবার অন্যভাবে ব্যাখ্যা দিলে আবেগের কারণে আমাদের মাংসপেশির সঞ্চালনায় হাসির উদ্রেক ঘটে, তখন মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন নিঃসরণ হয়। অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র মতো অবস্থা। মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম আর এমিগডালা নামক অংশের সক্রিয়তাও হাসি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, হাসি আমাদের মনের উদ্বিগ্নতা দূর করে, রাগ আর দুঃখ দূর করে; তাই হাসির গুরুত্ব রয়েছে।

হাসি আমাদের অপরের সঙ্গে যোগাযোগের একটি মাধ্যম। কারণ, মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ সাধারণত একা একা হাসে না, অন্যদের সামনেই হাসে। হাসি কিন্তু সংক্রামক, অর্থাৎ আড্ডায় একজন হাসা শুরু করলে তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। হাসির সময় আমাদের মুখ, গলা, ঘাড়, বুক, হাতের মাংসপেশির সঞ্চালন ঘটে, নিশ্বাস–প্রশ্বাসের পরিবর্তন হয়। স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে এমন একটি শিশু কথা শেখার আগেই হাসতে শেখে। সাধারণত জন্মের তিন থেকে চার মাসের মধ্যে সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসতে পারে, তবে জন্মের ছয় মাসের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসতে না পারলে ধরে নিতে হবে তার বিকাশ ধীরে হচ্ছে। শিশু দিনে প্রায় ১০০ বার হাসে আর পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন প্রায় ১০ বার হাসেন। হাসি নিয়ে গবেষণা অনেক। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে না গিয়ে সাধারণভাবে আমরা বেশ কয়েক ধরনের হাসি দেখতে পাই—অট্টহাসি (জোরে শব্দ করে হাসা), মুচকি হাসি (শব্দহীন হাসা), কাষ্ঠ হাসি (কষ্ট চেপে হাসা), বাঁকা হাসি (ব্যঙ্গাত্মক হাসি), চাপা হাসি (যতটা খুশি ততটা প্রকাশ না করে মনে মনে হাসা), ক্রূর হাসি (প্রতিশোধের হাসি), মেকি হাসি (নকল, সাজানো হাসি) ইত্যাদি।