স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক সৈয়দ আলী আহসান।

মুহাম্মদ আলতাফ হোসেনঃ
সৈয়দ আলী আহসান বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক কবি, সাহিত্য সমালোচক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক এবং শিক্ষাবিদ। 

১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন । তিনি তার পাণ্ডিত্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। সৈয়দ আলী আহসান কৃত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের ইংরেজি অনুবাদ সরকারি ভাষান্তর হিসাবে স্বীকৃত। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কবি, প্রাবিন্ধিক, গবেষক, সম্পাদক, অনুবাদক ও জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ১৯২২ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে মার্চ বর্তমান মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পুরোনো ঢাকা শহরের আরমানিটোলায় অবস্থিত আরমানিটোলা সরকারি হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স এসএসসি এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ বর্তমানে ঢাকা কলেজ থেকে এফএ এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ১৯৪৩ সালে স্নাতক বিএ এবং ১৯৪৪ সালে স্নাতকোত্তর এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি কলকাতা চলে যান। সেখানেই তিনি ১৯৪৬ সালের ৭ জুলাই বিয়ে করেন। তারপর যথাক্রমে অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা কেন্দ্রে এবং রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে কর্মসূচি নিয়ামকরূপে চাকুরি করেছেন। তিনি ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৩ খ্রীস্টাব্দে সৈয়দ আলী আহসান করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৬০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত সে পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর পরিচালক প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর পুনরায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৫ সালে ২৭শে সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০২ সালের ২৫শে জুলাই তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
তিনি ১৯৭৭ থেকে ৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও ধর্ম সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত ছিলেন। সুইডেনের নোবেল কমিটির সাহিত্য শাখার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৯ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক হিসাবে অভিষিক্ত হন এবং সে বছরই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। শেষ বয়সে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জাহাঙ্হীর নগর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও তিনি শিক্ষামহলে বেশ পরিচিত।

১৯৭১ সালে সৈয়দ আলী আহসান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। সে সময় তিনি চেনাকণ্ঠ ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন।কবিতা সম্বন্ধে সৈয়দ আলী আহসানের ধ্যান ধারণা সমকালীন কবিদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে তেমন একটা সাজুয্য রক্ষা করে চলেনি। যদিও তার রচনরায় রয়েছে ঐতিহ্য চেতনা, সৌন্দর্যবোধ এবং স্বদেশপ্রীতি, যা অন্য কবিদের লেখাতেও বর্তমান। কবির অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত কে সেরা সংকলন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।একক সন্ধ্যায় বসন্ত কাব্যগ্রন্থে প্রধানত গদ্য কবিতা স্থান পেয়েছে, সেই গদ্য কবিতা রবীন্দ্রনাথ এবং ত্রিশের কবিদের গদ্য কবিতা থেকে পৃথক। কেন না তার কবিতায় উপমা ও শব্দ ব্যবহারে রয়েছে নতুনত্ব এবং আধুনিকতা। উপমা ব্যবহারে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তার পার্থক্য এই যে জীবনানন্দে আছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপমা আর সৈয়দ আলী আহসান প্রধানত ব্যবহার করেছেন বিমূর্ত উপমা। তার উপমার কারুকাজ স্থাপনা কৌশল সচেতন পাঠককে মুগ্ধ করে। তার সন্ধ্যায় বসন্ত কাব্য সংকলনের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রার্থনা এবং আমার পূর্ববাংলা কবিতা।